দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিন ধরে চলমান, যা সাম্প্রতিক সময়ে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এবং তারা মনে করেন, জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত সরকারের হাতে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরই দেশের জন্য ইতিবাচক হবে।
গণঅভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত এনসিপি শুরু থেকেই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে রাজনৈতিক মিত্রতা বজায় রেখেছিল এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে একই মঞ্চে আন্দোলন করেছিল। তবে জামায়াত ইস্যুতে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস ঘিরে এনসিপি ও জামায়াতের মধ্যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের কার্যক্রমকে সংবিধানবিরোধী বলে মন্তব্য করেন এবং তার শপথ লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলেন। মাহফুজ আলমের ফেসবুক পোস্টের পরে এনসিপি আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি দেয়।
বিএনপি নেতারা ইশরাক হোসেনের শপথ নিয়ে আন্দোলন থেকে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলমের পদত্যাগ দাবি করেন। বিএনপি জানায়, অন্তর্বর্তী সরকারের যেসব উপদেষ্টা নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত, তাদের অব্যাহতি দিতে হবে। নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতেও তিন দলের মধ্যে মতভেদ রয়েছে—বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চায়, জামায়াত চায় সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন এবং এনসিপি চায় ইসি পুনর্গঠন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে আন্দোলন হয় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে, যেখানে ছাত্র শিবির, হেফাজতে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগঠন যুক্ত হয়। অবস্থান কর্মসূচি পরে শাহবাগে স্থানান্তরিত হয় এবং সেখানে বিতর্কিত স্লোগান ও জাতীয় সংগীত পরিবেশনের সময় বাধার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনাগুলো পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলনের মুখে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ জরুরি বৈঠকে বসে এবং কার্যক্রম নিষিদ্ধের ঘোষণা দেয়। তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তার ফেসবুক পোস্টে যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা ও পাকিস্তানপন্থা ত্যাগের আহ্বান জানান, যা পরে তিনি সরিয়ে ফেলেন। এ নিয়ে জামায়াত ও শিবিরের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয় এবং মাহফুজ আলমের পদত্যাগের দাবি ওঠে।
৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর বিএনপির ভূমিকায় পরিবর্তন আসে এবং দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনা বাড়ে। ইশরাক হোসেনের শপথ নিয়ে বিলম্বের প্রতিবাদে বিএনপির সমর্থকেরা আন্দোলনে নেমে আদালতের আদেশে তা পূর্ণতা পায়, ফলে বিএনপি রাজনীতির অঙ্গনে এনসিপি-জামায়াতকে ছাপিয়ে সামনে চলে আসে। বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের অব্যাহতি, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার অপসারণ এবং ডিসেম্বর ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচনসহ রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানায়।
ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে তার সমর্থকেরা কয়েকদিন অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন, যা হাইকোর্টে রিট খারিজের পর ৪৮ ঘণ্টার জন্য স্থগিত হয়। নির্বাচন কমিশনের সামনে এনসিপি নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ইসি-কে বিএনপির দলীয় কার্যালয় এবং মুখপাত্র হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি আরও বলেন, ইসি পুনর্গঠন না হলে জাতীয় নাগরিক পার্টি বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন করতে দেবে না।
বৃহস্পতিবার গুলশানে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িতদের উপস্থিতি সরকারের নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ পরিচিতি প্রশ্নবিদ্ধ করছে, তাই তাদের অব্যাহতি প্রয়োজন। তিনি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বক্তব্যকে বিতর্কিত বলে উল্লেখ করেন এবং তার অপসারণ দাবি করেন।
এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ আওয়ামী লীগের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিএনপি চলে বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু তার কড়া প্রতিক্রিয়া জানান এবং এনসিপি নেতাদের ভাষা ব্যবহারে সতর্কতা ও গণতান্ত্রিক রীতির প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রাখার আহ্বান জানান।
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র হলেও সম্প্রতি তাদের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে। লন্ডনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানের সাক্ষাতের পরও আদর্শ ও কৌশলগত কারণে দূরত্ব আরও বাড়ে। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর থেকে দুই দলের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ, সংস্কার, নির্বাচন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কসহ বিভিন্ন বিষয়ে মতভেদ দেখা যায়। পাবনার আটঘরিয়ায় কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যপদ নিয়ে দুই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও কার্যালয় ভাঙচুরের অভিযোগ ওঠে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের একটি অংশ দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার পক্ষপাতী এবং দলগুলোর বিভাজনে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নিতে পারে। বিভক্তিতে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের আশঙ্কাও রয়েছে। সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিএনপি বা এনসিপি যেকোনো পক্ষের ভুল পদক্ষেপ পরিস্থিতি আরও জটিল করতে পারে এবং এতে চূড়ান্তভাবে গণঅভ্যুত্থানের পরাজিত শক্তি লাভবান হতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইশরাক হোসেনের মেয়র পদ ইস্যুকে জাতীয় ইস্যুতে পরিণত করে বিএনপি শক্তি প্রদর্শনের রাজনীতি করছে এবং নির্বাচনের নির্দিষ্ট দিনক্ষণ দাবি অব্যাহত রেখেছে। এনসিপি-বিএনপির মধ্যে মূলত শক্তির পরীক্ষা চলছে, যা গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোতে বিভেদ ও অস্থিরতা বাড়াবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করতে চান বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় মাহফুজ আলম তার বিভাজনমূলক বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্যের আহ্বান জানান এবং এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহসহ আরও কয়েকটি দলও ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ইশরাক হোসেনের মেয়র পদে শপথ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিহিংসামূলক আচরণ করছে এবং জনগণের নির্বাচিত সরকার ছাড়া পরিস্থিতি স্থিতিশীল করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রচিন্তক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্নত করতে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন এবং সংশ্লিষ্ট দলগুলোর দায়িত্বশীল ভূমিকা অপরিহার্য।